বিষধর সাপে কামড়ালে কি করা উচিত

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে সাপের কামড় একটি সাধারণ সমস্যা। বিশেষ করে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে সাপের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সাপে কামড়ানোর উপদ্রবটি সম্প্রতি বেশ বেড়েছে। গ্রামীণ জীবনে সাপে কাটার বিষয়টি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও মে থেকে অক্টোবর মাসে তা বেড়ে যায়। তবে সাপে কাটলেই যে বিষক্রিয়া হবে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। অনেকের জানা, দেশে বিষধর সাপের চেয়ে নির্বিষ সাপের সংখ্যাই বেশি।

তবে অনেকে এ সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন না  এক্ষেত্রে তাদের কি করার রয়েছে। সাপ কামড়ালে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এ সময় ভয় থাকলেও ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। তবে বিষধর সাপে কামড়ালে পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা বিষধর সাপে কামড়ালে কী করা উচিত, কামড়ের লক্ষণ কীভাবে চিহ্নিত করবেন এবং প্রাথমিক চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আলোচনা করব। 

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় তিন লাখের মতো মানুষ বিষাক্ত সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সর্পদংশন প্রায়ই ঘটে। বাংলাদেশে প্রায় ১২ প্রজাতির সামুদ্রিক সাপসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে ছয় ধরনের সাপ বিষধর। 

সেগুলো হলো:

১. গোখরো বা কোবরা

২. পদ্মগোখরো বা রাজগোখরো বা কিং কোবরা 

৩. শঙ্খিনী বা ব্যান্ডেড ক্রেইট, কেউটে 

৪. চন্দ্রবোড়া, রাসেলস ভাইপার 

৫. সবুজ সাপ বা গ্রিন স্নেক  

৬. সামুদ্রিক সাপ বা সি-স্নেক

বিষধর সাপের কামড় সনাক্ত করার উপায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত, বিষধর সাপের কামড়ের কিছু উল্লেখযোগ্য লক্ষণ রয়েছে, যা আপনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন:

সাপে কামড়ের দাগ: কামড়ের স্থানটি প্রায়শই দুটি ছোট দাগ ফেলে। এই দাগগুলো সাধারণত গর্তের মতো হয়, যা সাপের দাঁতের প্রভাব নির্দেশ করে। সাপে কামড়ের ফলে কামড়ের স্থানটিতে জ্বালা, ব্যথা এবং ফোলাভাব দেখা দেয়। কামড়ের চারপাশে বিষের দাগ বা রক্তপ্লাব হতে পারে। 

অস্বস্তি ও ব্যথা: কামড়ানো স্থানে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয় এবং এটি আস্তে আস্তে পুঁজ করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, কামড়ের স্থানের আশেপাশে ফোলাভাব দেখা যায়। 

শারীরিক লক্ষণ: বিষাক্ত সাপের কামড়ে মাথা ঘোরানো, মাংসপেশিতে দুর্বলতা, বমি, অথবা হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক কাজকর্ম দেখা দিতে পারে। কিছু লোক কামড়ের পরে অ্যালার্জির কারণে তাত্ক্ষণিকভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারে।

মৃত্যুর সম্ভাবনা: কিছু ক্ষেত্রে, বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যু ঘটতে পারে। তাই সতর্ক থাকা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

সাপের কামড়ের আরো কিছু  লক্ষণ

  • বিষ ছড়িয়ে পড়লে বমি হওয়া। 
  • শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া বা কাঁপুনি আসা।
  • অ্যালার্জি, চোখের পাতা ঝরে যাওয়া।
  • ক্ষতস্থানের চারপাশে ফুলে যাওয়া।
  • জ্বালাপোড়া ও লাল হয়ে যাওয়া।
  • ত্বকের রঙ পরিবর্তন, ডায়রিয়া, জ্বর, পেটে ব্যথা, মাথাব্যথা, বমি-বমি ভাব, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, ক্লান্তি, পেশিতে দুর্বলতা, তৃষ্ণা বোধ, নিম্ন রক্তচাপ ইত্যাদি হতে পারে। 

সাপে কামড়ালে করণীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি আপনি বা আপনার পরিচিত কেউ বিষধর সাপের কামড়ের শিকার হন, তবে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত:

শান্ত থাকুন: প্রথমে আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। ধীরে ধীরে ও শান্তভাবে কাজ করুন। রোগীকে বিশ্রাম করতে বলুন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার আশ্বস্ত করতে হবে এবং সাহস দিতে হবে, আতঙ্কগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না। নির্বিষ সাপের কামড়েও আতঙ্কিত হয়ে মানসিক আঘাতে মারা যেতে পারে মানুষ।

ক্ষত স্থান ভালভাবে পরিষ্কার করুন: দংশিত স্থানে বিষ দাঁতের ক্ষত চিহ্ন আছে কিনা দেখতে হবে। কামড়ানো স্থানটি সাবান এবং পানি দিয়ে পরিষ্কার করুন, কিন্তু এটি খুব বেশি ঘর্ষণ করবেন না। মূলত জীবাণু দূর করার জন্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ঘড়ি বা অলঙ্কার বা তাবিজ, তাগা ইত্যাদি পড়ে থাকলে খুলে ফেলুন। কারণ এগুলো রক্তপ্রবাহে বাধা তৈরি করে ও অনেক সময় চিকিৎসা প্রক্রিয়ার জন্য সমস্যা হয়ে যায়। 

কামড়ের স্থানে চাপ দিন: আক্রান্ত স্থানে একটি পরিষ্কার কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে চাপ দিন। এটি রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এমনভাবে, যেন বাঁধন অনেক বেশি শক্ত অথবা ঢিলা না হয়। বাঁধনের নিচ দিয়ে যাতে দুটি আঙুল ঢোকানো যায়, তা যেমন বিষের প্রবাহের বাধা দিতে যথেষ্ট কার্যকর, তেমনি রক্ত চলাচলেরও উপযোগী থাকবে বলা যায়।

রোগীর তথ্য সংগ্রহ করুন: সাপে কামড়ানোর পরে কামড়ানো সাপটির প্রকার নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি চিকিৎসায় সহায়তা করবে। যদি সাপটিকে ইতোমধ্যে মেরেই ফেলেন, তাহলে সেটি হাসপাতালে নিয়ে আসুন। তবে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

সাপের বিষের প্রতিষেধক: চিকিৎসকরা রোগীকে বিষের প্রতিষেধক দিতে পারেন। এটি সাপের বিষের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে। সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসেবে অ্যান্টিভেনম ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি রোগীর অবস্থার ওপর নজর রাখা জরুরি। 

হাসপাতালে যাওয়া: যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা সঠিক চিকিৎসা প্রদান করবেন। বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

সাপে কামড়ালে কিছু ভুল ধারণা বা ভুল পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। নিচে কিছু কাজ উল্লেখ করা হলো যা করা উচিত নয়:

কামড়ের স্থান কেটে ফেলা: সাপে কামড়ানো স্থানে কাটার মাধ্যমে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না। কিংবা বিষ চুষে নেওয়ার চেষ্টা না করা। এটি আরো ক্ষতি করতে পারে এবং সংক্রমণ বাড়িয়ে দিতে পারে। 

লিগেট ব্যবহার করা: কামড়ের স্থানটিকে লিগেট বা টাইট বাঁধবেন না। এটি রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করতে পারে এবং আরও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণত দেখা যায়, হাত বা পায়ে কামড় দিলে, কামড়ানো জায়গা থেকে ওপরের দিকে দড়ি বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়, যাতে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। বরং এতে হাত/পায়ে রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে রক্ত প্রবাহের অভাবে টিস্যুতে পচন (Necrosis) শুরু হতে পারে।

আলকোহল বা নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়া: কামড়ের পরে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাওয়া বা পান করা উচিত নয়। এটি বিষের প্রভাব বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না।

ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার: সাপে কামড়ালে ঘরোয়া প্রতিকার যেমন হলুদ, আদা ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।  এছাড়া কোনো ভেষজ ওষুধ, লালা, পাথর, উদ্ভিদের বীজ, ইত্যাদি লাগানো যাবে না। এটি আপনার অবস্থা আরও খারাপ করতে পারে। 

শারীরিক কার্যকলাপ: আক্রান্ত ব্যক্তিকে শারীরিক কার্যকলাপ করতে বলবেন না। এটি বিপজ্জনক হতে পারে। যদি আক্রান্ত ব্যক্তির গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা হয়, বমি, অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, নাসিক কণ্ঠস্বর ইত্যাদি দেখা দেয় তাহলে কিছু খাওয়ানো যাবে না। এছাড়া বেশি নড়াচড়া বা হাটাহাটি করা যাবে না। একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির হয়ে বসতে হবে।  

বিষধর সাপে কামড়ালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। বিষধর সাপের কামড়ের লক্ষণ চিহ্নিত করা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা জীবন রক্ষাকারী হতে পারে। সাপের কামড় হলে অতি দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, সচেতন থাকুন এবং সাপের কামড় হলে কী করা উচিত সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানুন। এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এই বিপদ থেকে নিরাপদে থাকা যায়।

dr. shahidul islam
Website: https://drsmshahidulislam.com/
Dr. S.M Shahidul Islam
Pain & Paralysis Doctor

Dr. Shahidul Islam বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ। সেই সাথে Pain and Paralysis ডাক্তার হিসেবেও ব্যপক সুনাম অর্জন করেছেন। বাংলাদেশে ঔষধ বিহীন চিকিৎসা আকুপাংচার এর ব্যবহারকে এগিয়ে নিতে ব্যপক ভূমিকা পালন করছেন। তার চিকিৎসায় অসংখ্য রোগী কোমর ব্যথা থেকে সুস্থ্যতা লাভ করেছেন। তিনি যেকোন ধরনের ব্যথার চিকিৎসায় সফলতার খ্যাতি অর্জন করেছেন। Dr. Shahidul Islam বর্তমানে শশী হাসপাতালে ভিজিটিং কনসালট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত আছেন। মূলত তার তত্বাবধানে দেশসেরা আকুপাংচার চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

Leave a Reply

Receive the latest news

Subscribe To My Weekly Newsletter

Get notified about new articles